Fri, Nov 17 2017 - 5:46:07 PM +06

মাতলো দেশ অগ্রহায়নের নবান্ন উৎসবে


News Image

সাগরিকা মন্ডল :

বারো মাসে তের পার্বনের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের প্রচলিত উৎসবের মধ্যে নবান্ন উৎসব অন্যতম।  নবান্ন মানে নতুন অন্ন।সাধারণত নবান্ন হয়ে থাকে অগ্রহায়ন মাসে। সে সময় আমন ধান কাটা হয়। এই নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না উপলক্ষে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। নবান্ন উৎসব এর অন্যতম প্রথা হচ্ছে কাকবলি। আর কাকবলির শুরুটাই হয় ‍অগ্রহায়নে। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ অগ্রহায়ন। তাই নবান্নের উৎসবটাও জমে উঠেছে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে।

নবান্ন বা কাকবলি কি ? একটি কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়।নবান্ন উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় এই নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে। অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই আমাদের গ্রামবাংলায় চলে নানা উৎসব-আয়োজন।

 

নতুন ধান কাটা আর সেই সাথে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ- এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব।

হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় হলুদ-সবুজ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। কারণ কৃষকের ঘর ভরে ওঠে গোলাভরা ধানে। স্মরণাতীতকাল থেকে বাঙালি জীবনে অগ্রহায়ণে কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে নিয়ে আগমন ঘটে এ ঋতুর। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নুতন ধানের চাল দিয়ে তেরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকম খাবার। আর এসব খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চার পাশ। সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্নকে ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের ভাবনায় ফুটে উঠেছে প্রকৃতির চিত্র। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছেন- আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্কচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি।


তাই অগ্রহায়ণ এলেই কৃষকের মাঠ জুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে এ দেশের কৃষক-কৃষাণীর। ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা ।ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামবাংলা। অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তার পরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশ। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর- পায়েসসহ নানা উপাদান। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া-দাওয়ার ধুম। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে নাইওর আনা হয়। নবান্ন আর পিঠাপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র বেজে ওঠে নতুন ধ্বনি। যেহেতু নবান্ন একটি ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব, তাই বছর ঘুরে ফিরে আসে নবান্ন উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়।

 

 

হাজার বছরের পুরনো এই উৎসবটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে পালন করে আসছে সবাই। সবচেয়ে ঐহিত্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাটির সাথে চিরবন্ধনযুক্ত নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসবে গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার। এসব মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। উৎফুল্ল দেখা যায় গ্রামের সহজ সরল মানুষকে। হরেক রকম দোকান দিয়ে বসানো হয় গ্রামীণ মেলা। তবে গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না, শহরেও ব্যাপকভাবে বসে গ্রামীণ মেলা। রাজধানীতে বেশ কয়েকটি সংগঠন আলাদা আলাদাভাবে অগ্রহায়ণের প্রথম তারিখে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে।

এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মণ্ডা-মিঠাই। সেই সাথে মাটির বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র এ মেলায় চোখে পড়ে। শহরের মানুষজন এ উৎসব প্রাণভরে উপভোগ করে থাকে। অনেকে বাড়িতে পিঠাপুলির আয়োজন না করতে পারলে বছরে অন্তত একবার নবান্নের মেলায় এসে পিঠাপুলির স্বাদ নিয়ে থাকেন। তখন হয়তো মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দূর অতীতের কথা, যেখানে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই একসাথে মিলে নবান্নের দিনে নানা ধরনের পিঠাসহ আয়োজন করা হয় সুস্বাদু খাবারের। সেই খাবারের বাহারি স্বাদের কথা মনে পড়লে এখনো উদ্বেলিত হয় মানপ্রাণ।তবে ৪৭ এর দেশভাগের পর এই উৎসব ধীরে ধীরে কদর হারাতে থাকে।