হলি টাইমস রিপোর্ট :
প্রতিবছর সৃজনশীল বইয়ের সিংহভাগ প্রকাশিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকেই। জনপ্রিয় এবং পুরনো লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকরাও প্রথাগতভাবে বইমেলাতেই তাদের বইটি প্রকাশ করেন।
কিন্তু পরিচিত লেখকদের পাশাপাশি এই বইমেলায় নতুন বা অপেক্ষাকৃত নতুন লেখকেরা কতটা উঠে আসতে পারছেন?
"বাংলাদেশের নতুন লেখকদের কিছু প্রতিবন্ধকতাতো রয়েছে। প্রকাশকরা তার পেছনেই বেশি ছুটছেন, যাদের বই বেশি কাটতি হয়। আমাদের মত নতুনদের জন্য খুবই কঠিন একটি জায়গা"। বলেন নতুন লেখকদের একজন সৈয়দ জাহিদ হাসান।
যদিও তিনি বলছেন, তার অভিজ্ঞতা তুলনামূলক ভাল। প্রকাশক তার বইয়ের প্রচারণা চালিয়েছেন। এই বইমেলায় তার লালনবিষয়ক একটি গবেষণামূলক গ্রন্থসহ একাধিক বই প্রকাশিত হচ্ছে।
বইমেলায় কথা হল আরেকজন নতুন লেখক আরজু নাসরিন পনির সাথে। তার লেখা দ্বিতীয় বইটি বের হয়েছে এই বইমেলায়। একটি গল্প সংকলন।
তিনি বলছিলেন, প্রকাশনা সংস্থা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের কিছু প্রচারণা চালালেও নতুন লেখকদের জন্য বইমেলা চলাকালে নতুন পাঠকদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ কম।
নতুনদের বই এবং লেখকের নামের সাথে বই সম্পর্কে কিছুটা তথ্যও যদি পাঠকদের দেয়া যায় তাহলে হয়তো পাঠকদের নতুন লেখকদের সম্পর্কে আগ্রহ বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তবে নতুন লেখকদের পরিচিতি পাওয়ার সুযোগ যে খুব কম তা মনে করেন না আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি। তার মতে, মূল সমস্যাটি হল এখনকার লেখকদের একটি বড় অংশ শুধুমাত্র লেখক পরিচয়ের জন্যই বই লিখছেন। যাদের লেখার অধিকাংশ বই হিসেবে গণ্য করা যায় না।
"ছোট বা বড় সব প্রকাশকের তালিকায় এখন নতুন লেখকের সংখ্যা অনেক বেশি, পুরনো লেখকদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে" বলেন মি. গনি।
"এই যে নতুন লেখকদের পাঠকরা খুঁজে পাচ্ছেন না। তারা পত্র-পত্রিকায় তো লিখছেন না। সেখানে লিখে তাদের কলমকে শাণিত করতে হবে। সেটাতো তারা করছেন না। প্রচারের জন্য তাদের নিজেদেরও ভূমিকা আছে"। নতুন লেখকদের প্রচারণার বিষয়ে মি. গনির মতামত।
এই প্রকাশক বলছেন, মানহীন বই কিনে অনেকসময় পাঠকেরা প্রতারিত হচ্ছেন এবং নতুন লেখকদের ওপর আস্থাও হারাচ্ছেন
কিন্তু মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা এতটা কম হবার কারণ কি?
বইমেলায় যে লেখকদের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, তাদের একজন সাহিত্যিক আনিসুল হক।
তিনি বলছিলেন, বইমেলা নতুন লেখকদের বেশ কিছু ভালো বই প্রকাশিত হলেও, অনেক বইয়ের লেখকরা পুরোপুরি তৈরি না হয়েই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছেন।
"বইমেলা না থাকলে নতুন লেখকদের জন্য নিজের প্রতিভা প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি করা আরো কঠিন হতো। বইমেলায় যদি চার হাজার বই যদি বেরিয়ে থাকে, তার মধ্যে ক'টা মানসম্মত, ক'টা পাঠকের কাছে গেছে এবং লেখক কী পেলেন? স্বীকৃতিও পেলেন না, বইটা বিক্রিও হল না"
"অনেকসময়ই হতাশা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না" বলেন আনিসুল হক।
সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলছেন, এভাবে মানহীন লেখা এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে এতোগুলো বই প্রকাশের ফলে পাঠকেরা শুধুমাত্র জনপ্রিয় এবং পরিচিত লেখকদের দিকেই ঝুঁকছেন।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, অনেক প্রকাশকের লেখকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বই প্রকাশের প্রবণতা।
"প্রকাশকের দায়িত্ব ভালো পাণ্ডুলিপি বেছে বই বের করা। বই বের করার সময় আমি দেখবো যে সেই লেখকের বই প্রকাশযোগ্য কিনা। কিন্তু আমি যদি টাকা নিয়ে বই বের করে দেই, তাহলে সেটা জাতির জন্য খুব দু:খজনক"।
নতুন লেখক, বিশেষ করে প্রবাসী লেখকদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে এধরণের বই প্রকাশের প্রবণতা বেশি দেখা যায় বলে জানাচ্ছেন লেখক-প্রকাশকরা।
অর্থের বিনিময়ে বই প্রকাশের এই সংস্কৃতি পাঠকদের আস্থাহীনতার একটি বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন তরুণ লেখক সৈয়দ জাহিদ হাসান।
মানহীন বইয়ের কারণে পাঠক যেমন আস্থা হারালেও, মানসম্মত বইয়ের তথ্যও সব পাঠকের কাছে পৌঁছাছে তেমনিও নয়।
প্রকাশকরা বলছেন, তারা হয়তো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, কিন্তু শুধুমাত্র তার মাধ্যমে পাঠককে বই সম্পর্কে জানানো যাবে না।
লেখক আনিসুল হক মনে করেন, নতুনদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এখানে সমালোচনা সাহিত্য গড়ে না ওঠাটা একটি বড় সমস্যা।
"পত্রিকার সাহিত্য পাতায় হয়তো কিছু বইয়ের আলোচনা করে। কিন্তু সেটাও বিখ্যাত লেখক হতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ লেখা হতে হবে অথবা যেটা হয় একদমই খাতিরে পরিচিত লেখকদের সুযোগ দেয়া। যার ফলে, নতুন লেখক ভালো লিখলেও তার পক্ষে পরিচিতি পাওয়াটা কঠিন" বলেন আনিসুল হক।
তিনি বলেন, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পাদনার দিকে নজর না দেয়াটাও আরেকটি সমস্যা।
কিন্তু নতুন লেখকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বইমেলা যারা আয়োজন করে, সেই বাংলা একাডেমি কতটা ভূমিকা রাখছে?
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলছেন, তারা এবারের মেলায় নতুন বইয়ের প্রদর্শনশালা করেছেন, যেখানে পাঠকরা নতুন বইগুলো দেখতে এবং পড়তে পারেন। এছাড়া মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানকে ঘিরে প্রকাশিত বই নিয়ে কেউ আলোচনা অনুষ্ঠান করতে চাইলে তাতেও তারা সাহায্য করতে পারেন।
তবে নতুন লেখকদের জন্য সবটাই হতাশা নয়, আশার কথাও বলছেন লেখক-প্রকাশকরা।
"যদি প্রকৃতপক্ষে কোন লেখক ভাল লেখেন, তাহলে তার সেই প্রতিভা চাপা থাকবে না। মানুষ এটা জেনে যাবেন"। বলেন লেখক আনিসুল হক। খবর বিবিসির