Contact For add

Tue, Nov 7 2017 - 5:38:55 PM +06 প্রচ্ছদ >> বিশেষ খবর

Don't Stop Kanya Shishu Violenceথামছেনা কন্যা শিশু নির্যাতন

থামছেনা কন্যা শিশু নির্যাতন


থামছেনা কন্যা শিশু নির্যাতন

সাগরিকা মন্ডল :
থামছেইনা কন্যা শিশু নির্যাতন। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে সরকারি এতো কর্মপরিকল্পনা আইন থাকতেও কন্যা শিশুদের প্রতি প্রতিনিয়ত সহিংস ঘটনা ঘটছে। গড়ে দিনে দু’টি ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং উদ্বিগ্ন করে তুলেছে অভিভাবকদের।
সরকার প্রাণান্ত চেষ্টা করার পরও কেন এমন হচ্ছে? কন্যা শিশু ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম এ সবুর বলেছেন, কন্যা শিশুদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের অভাবে এমনটা ঘটে থাকতে পারে। তার মতে, কন্যা শিশুকে হ্যাঁ বলুন।
কিন্তু কেন ? নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। খ্রীষ্টিয় ধর্মে একটি প্রবাদ আছে, গড কুড নট বি এভরি হয়ার, সো হি ক্রিয়েটেড মাদারস্। হিন্দু ধর্মের  দেবতা গনেশ আরো একটু এগিয়ে বলেছেন, মা হচ্ছে আমার ব্রহ্মান্ড। রাসুল (সা:) এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মাকে বাবার চেয়ে তিনগুণ  বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত দিয়েছেন।
বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, মাদারস আর ফাউন্ডার দ্যান ফাদারস অব দেয়ার চিলড্রেন বিকজ দে আর মোর সারটেইন দে আর দেয়ার ওউন। এরকম অগুনিত দার্শনিক জ্ঞানি গুণী ব্যক্তিরা মাকে  শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান দিয়েছেন। শ্রীরাম, শ্রী কৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুসহ মহাজ্ঞানীরা মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে পৃথিবীকে আলোাকিত করেছেন। এই মা’কেও ছোট থেকে বড় হতে হয়েছে। মা’র ও ছিল শিশুকাল। তারপর  কৈশর পেরিয়ে যৌবনে এসে মা’ হতে হয়েছে। মাও ছিলো কন্যা, ছিলেন কন্যা শিশু। সত্যিকার অর্থে একজন কন্যা শিশুকে একজন তেজস্বি মা করতে হলে , রতœগর্ভা মা করতে চাইলে শিশুকালেই তার বেড়ে ওঠার যতœ, তার সামাজিক পরিবেশ তৈরি, তার শিক্ষা, সংস্কৃতি , আত্মমর্যাদাশীল হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে হবে। আর এটা করতে হলে প্রতিটিক্ষণ কন্যা শিশুকে হ্যাঁ বলুন।
অঙ্কুরোধগমের পর পুস্প চারাকে প্রতিদিন একটু জল, জৈব খাবার এবং যতœ করলে ধীরে ধীরে সে বড় হয়ে ওঠে। তারপর যেমন ধরনীকে ফুলে ফলে সুশোভিত করে, ঠিক তেমনি একটি কন্যা শিশুকে ছোটবেলা থেকেই যতœ করে, তার পারিপার্শিক অবস্থাকে ইতিবাচক করে রাখলে সে একদিন শিক্ষিত সুন্দর মা হবে। এই মা-ই উপহার দেবে একটি সুন্দর জাতি।
আসলেই কি কন্যা শিশুদের পারিপার্শিক অবস্থাটা এরকম ভালো ? বাস্তবতা মোটেও তেমন নয়। প্রতিদিনই কন্যা শিশুদের প্রতি সহিংস ঘটনা ঘটছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং পথকন্যা শিশু কমবেশি সবাই শিকার হচ্ছে নির্যাতন, যৌন নিপিড়ন, শ্লীলতাহানির। পণ্যের মতো পাচার হচ্ছে, ঘটছে কন্যা শিশু খুনের ঘটনা। এমনকি কন্যা শিশু যাতে ভূমিষ্ট না হয় তার জন্য কন্যা শিশু ভ্রুন হত্যা করা হচ্ছে অহরহ।
অনেক কন্যা শিশুই ঘরে বাইরে সবখানে অনিরাপদ মনে করে । এতে ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে মানুষ, সমাজ, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে তাদের। যা একজন সুস্থ্য সবল সুন্দর মা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
সবগুলো ছদ্ম নাম ব্যবহার করে বলছি, মিরপুরের ১২ বছর বয়সী লামিয়ার কথাই ধরুন। দুই মাস পরেও তার ঘোর কাটেনি। পুরুষ লোক দেখলেই সে ভয় পায়, এমনকি বাবাকেও। প্রতিবেশি এক বৃদ্ধ দাদা তাকে ধর্ষন করেছে। শিশু মনের ওপর তার এই আঘাত সারবে কী ? কালিয়াকৈরে মুক্তিকে শুধু ধর্ষনই নয় ঘার মটকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার কলেজের ও কর্মক্ষেত্রের বান্ধবীরা এখনো স্বাভাবিকই হতে পারছেনা, ভয় তাড়া করে ফিরছে তাদেরও। জয়পুর হাটের বেগুন গ্রামের খোরশেদ আলমের ৬ বছরের কন্যা শিশুটি এখনো যন্ত্রনায় কাতর হয়ে যায়।  সে ধর্ষন কি তা হয়তো বোঝেনা। কিন্তু যন্ত্রনাটা ঠিকই তাকে কষ্ট দেয়। বগুড়ায় শেরপুরের শান্তিনগরের নার্গিস আক্তার অন্যের বাসায় কাজ করতে গিয়ে যে শারীরিক নির্যাতনের ক্ষত বইছে তা শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে যাবে আমৃত্যু। আমেনার কথা মনে আছে সবার। ১০ বছরের এই গরীব মেয়েটি রাজধানীতে একটি পরিবারে গৃহকর্মী ছিল। পিঠে দগদগে ঘা অসংখ্য খুন্তীর ছেঁকা আর মারের ছোপ ছোপ রক্তের দাগ নিয়ে রেলস্টেশনে পড়ে ছিল  সে। এই চিত্র যারা দেখেছেন তাদের কোন কন্যা শিশুকে আর কাজের মেয়ে হিসেবে কারো বাড়ীতে পাঠাবে কী ? পিরোজপুরের আলমকাঠিতে পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্রীর পড়ালেখাই বন্ধ হয়েছিল বখাটাদের ইভটিজিংয়ের কারণে। এরকম হাজারো কন্যা শিশুকে নির্যাতন ঘটনা ভয় আতংকের বীজ বপন করে দেয়। যা ছড়িয়ে যায় সমাজের অন্য সব কন্যা শিশুদের মনের মধ্যে।
শিশু অধিকার  ফোরামের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি  থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২৯৪ জন শিশু ধর্ষণ এবং ৪৬ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ২৪ জন শিশু প্রতিবন্ধী। হিসাব মতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় দু’জন শিশু  কোথাও না  কোথাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ পরিসংখ্যান  থেকেই  উপলব্ধি করা যায়, শিশু ধর্ষণ কতটা ভয়াবহরূপ নিয়েছে। এর সঙ্গে ঘটছে, ইভটিজিং এবং শ্লীলতাহানির ঘটনাও।
ফোরামের এক পর্যালোচনামূলক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ৩৫৮৯টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনে শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, ১৪৪১টি, অপঘাতের শিকার ২০৫টি,  যৌন নির্যাতনের শিকার ৬৮৬টি, অপহরণ, নিখোঁজ ও উদ্ধার ৪৪৫টি শিশু, নির্যাতন সহিংসতার শিকার ৩৯৮টি এবং অন্যান্য ৪১৪টি।
বিবিসি‘র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের গেল ৭ মাসে  দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮০ টি। ২০১৬ সালে ছিল ১৭০টি। ২০১৫ সালে তা ছিল ৫২১টি। ২০১৪ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯৯টি। ২০১৩ সালে ১৭০টি এবং ২০১২ সালে ছিল ৮৬টি শিশু ধর্ষনের ঘটনা। গণধর্ষন আর ধর্ষনের চেষ্টার ঘটনাও বাড়ছে। অতিসম্প্রতি ধর্ষণ এবং ধর্ষনের পর খুনের ঘটনাও আতঙ্কিত করে তুলেছে কন্যা শিশুদের।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি সারা দেশে ২৬৫ টি উঠান বৈঠক করেছেন। যাতে শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো যায়। কন্যা শিশুরা যাতে পাচারের শিকার না হয়, নির্যাতনের শিকার না হয়, সে জন্য জনসচেতনতামূলক প্রচারণাও চালিয়েছেন সংস্থাটি ।
সামাজিক অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা, নারী ও শিশুদের প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা শিশুদের এমন নৃশংসভাবে ধর্ষণ, আঘাত বা হত্যা করার মানসিকতা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করে কর্মজীবী নারী সংস্থাটি।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের ঘটনা বাড়ার পেছনে কাজ করছে।
মানবাধিকার কমিশনের  চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধ এবং শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
শিশু অধিকার কর্মীরা বলেছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া  শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে  যে, বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করার তাগিতও রয়েছে তাদের।
দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যটর্নি  জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে বিচার চলার কারণে হতাশা বাড়ছে। তবে বিচারক স্বল্পতাও একটি বড় সংকট। এছাড়া মামলা ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ডিফেন্স ল ইয়ারের মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সমাজকর্মীরা বলেছেন, আসলে আমাদের মনমানসিকতা এবং নেতিবাচক সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন দরকার। শিশুদের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা যদি সুন্দর পৃথিবী চাই, মেধাবী জাতি চাই, আগামী ভবিষ্যৎ চাই তাহলে কন্যা শিশুদের নিরাপদ স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করতেই হবে।

 



Comments

Place for Advertizement
Add