সাগরিকা মন্ডল :
নানা রংবেরঙের নাম না জানা পাখিতে প্রতিবছর শীতকাল এলেই ভরে যায় জলাশয়, বিল, হাওড়, পুকুর । শীতের সময় বা বছরে এক বার আসে বলে সেগুলোকে বলি অতিথি পাখি। তারা অতিথির মতোই আসে বলেই নাম অতিথি । নিজেদের জীবন বাঁচাতে এই পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় শীতে।
শুধু ইউরোপ আর এশিয়ায় আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশে ও প্রায় ৬৬০ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে বলে জানা যায়।এর মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক ও ৩০০ প্রজাতি অনাবাসিক বা পরিযায়ী। এ দেশে গরম পড়লে পরিযায়ী পাখিদের প্রায় ৮০ শতাংশ হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের দেশ ও ২০ শতাংশ সুদূর সাইবেরিয়াসহ মধ্য ও উত্তর এশিয়ায় চলে যায়।
প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, উপমহাদেশে ২ হাজার ১০০টি প্রজাতির পাখি আছে। তবে এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩শ' প্রজাতির পাখি হিমালয় পেরিয়ে আমাদের দেশে চলে আসে। আবার শীতের সময় ফিরে আসে। তবে সব পরিযায়ী পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে ও ১০টি গ্রীষ্ম মৌসুমে এ দেশে দেখা যায়। কিছু কিছু পাখি প্রতিবছর ২২ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অনায়াসে চলে যায় দূরদেশে। এক জাতীয় সামুদ্রিক শঙ্খচিল প্রতিবছর উত্তর মেরু অঞ্চল অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে চলে আসে। তবে এ দেশে এখন আর ৬৬০ প্রজাতির পাখি নেই। ৩০-৩২টি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের দেশ থেকে।
আমাদের দেশে অতিথি পাখি আসার কারন :
পাখিদের আকাশে কোনো সীমান্তরেখা নেই। তারা অনায়াসে উড়ে বেড়ায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে। খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে তারা। বিচিত্র তাদের সন্তান পালন, বাসা তৈরির কৌশল। ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতির হাজারও প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে।
শীত এলে এরা পাখিরা সহ্য করতে না পেরে অন্য দেশে যেখানে শীত অপেক্ষাকৃত কম সেখানে চলে যায়। তাছাড়া এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেও দেখা যায় প্রচণ্ড অভাব। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সাথে রয়েছে তুষারপাত। তাই কোনো গাছপালা জন্মাতেও পারে না। তাই শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠাণ্ডা অঞ্চলের দিকে।বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। ঠিক এ রকম এক সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ।
যে কারনে আতঙ্কে থাকে শীতের পাখি :
প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে যেসব পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয় সুনিশ্চিত খাদ্যের সন্ধান, সন্তান জন্মদান ও বেঁচে থাকার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, যে পাখি বেছে নেয় এদেশের শ্যামল প্রকৃতিকে, শিকারীর শ্যেনদৃষ্টি থেকে বাঁচার সৌভাগ্য তাদের প্রায়ই হয় না। শিকারীর বন্দুকের গুলিতে কিংবা ফাঁদে বহু পাখি হারায় তাদের স্বজনকে। প্রানের মায়া সবারই আছে । এই বুঝি নিজের প্রাণটাও যায় এমন আতঙ্কও সারাক্ষণ অশান্তিতে কাটে অনেক পাখিরই। কিন্তু শিকারীরা তার পাষান হৃদয়ে শিকার করা অর্ধমৃত আহত পাখিকে শহরে, গ্রামে-গঞ্জের বাজারে কিংবা রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করে। আর প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্যে নয়, রুচির পরিবর্তনের জন্যেই অনেকে শিকার করে কিংবা কিনে নেয় এসব অতিথি পাখিদের । এসব পাখি শিকারীরা খুবই কৌঁশলি। এরা যেন যাদু জানে। অবিকল পাখিদের কন্ঠস্বরে এরা বাঁশি বাজাতে পারে। কণ্ঠস্বর নকল করে দূর থেকে পাতার বাঁশি বাজিয়ে পাখিদের ফাঁদের কাছে নিয়ে আসে। এসব কৌঁশলি শিকারীদের কাছ থেকে পাখিদের পালানোর কোনো উপায় তখন আর থাকে না।
অধ্যাপক সোহরাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, একদশক আগেও এদেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসতো। এ সংখ্যা প্রতি বছরই হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাপকহারে পাখি শিকার ও জলাভূমির সংখ্যা কমে যাওয়ায় অতিথি পাখিরা এদেশকে আর নিরাপদ ভাবছে না।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার শ্রীরামপুর, কলিগাতী, বারাশিয়া, কালশিরা, বেন্নাবাড়ি, রুয়েরকুলসহ বিভিন্ন বিল জুড়ে প্রায় অর্ধশত লোক এই পাখি শিকারের সাথে জড়িত রয়েছে। এলাকার পাগল মার্কেট, বারাশিয়া বাজারসহ চিতলমারী সদর বাজারেও এসব পাখি প্রকাশ্যে ও গোপনে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে এমনি কথা বলে ডুমুরিয়ার র্পাথ রায় নামে এক ভদ্র লোক।
এদিকে ফকির হাটের মিঠন রায় বলেন , ফকিরহাট এলাকার ফলতিতা বাজার,চিতলমারির পাগল মার্কেট, বারাশিয়া বাজারসহ সদর বাজারেও এসব পাখি প্রকাশ্যে ও গোপনে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা মতে ,পাখি শিকার ও হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ। তবুও অতিথি পাখি ধরছে শিকারীরা । আবার তাও চড়া দামে বিক্রি করেছে হাটে বাজারে । পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন আয় করছে হাজার হাজার টাকা।
অতিথি পাখিদের প্রান বাঁচাতে কঠোর আইনের পাশাপাশি জনসচেতনতা ও সৌন্দর্য পিপাসু মানসিকতা কামনা করেছেন চিতলমারীর উৎসব মূখর রায় । তিনি বলেছেন ,প্রকৃতির অনন্য উপহার অতিথি পাখি এ আমাদের নিজস্ব সম্পদ, সারা পৃথিবীর সম্পদ। এ গুলোকে বাঁচিয়ে রাখা ও নিরাপদে রাখা আমাদের কর্তব্য ।