Sat, May 18 2013 - 12:00:00 AM +06

শীতল কানাডা, উত্তাল বাংলাদেশ


News Image

 

হলিটাইম্‌স ডেস্ক 

শুজা রশীদ

আমাদের সাপ্তাহিক আড্ডায় বাদল ভাই প্রায়ই দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “এই দেশের পলিটিক্সে কোনো মজা নাই। দেখেও না, করেও না। কোনো গ্যাঞ্জাম নাই, ঝগড়াঝাটি নাই, মারপিট নাই। সবকিছু একেবারে পান্তা ভাত।”

আমরা কেউ রাজনীতি করি না। বাদল ভাই এখানে একটা পার্টিতে নাম লিখিয়েছিলেন। বারকয়েক তাদের মিটিংফিটিংয়ে গিয়ে তার নাকি ঘুম ধরে গিয়েছিল। বিরক্ত হয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশে মাত্র দুই-তিন সপ্তাহে যা হয়ে গেল তা থেকে বাদল ভাইয়ের কথার সত্যতা প্রমাণ হয়। এমন ঘটনাবহুল দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কি না সন্দেহ, বিশেষ করে যদি আঁকার-আকৃতিকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়।

সাভারের হৃদয়বিদারক (এবং রক্তে আগুন জ্বালানো) ধবনধসের জের শেষ হওয়ার আগেই হেফাজতে ইসলাম এবং বিরোধী দলের বিপুল সমারোহ এবং ঢাকা অবরোধ, জামায়াতে ইসলামী নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের যুদ্ধকালীন সময়ে কৃত অপরাধের জন্য ফাঁসির রায়– প্রতিটি ঘটনাই নিজ গুণে কিংবা দোষে শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আবার এই সবের মধ্যেই SSC এবং তার Equivalent পরীক্ষার ফল এসেছে– পূর্বের সব রেকর্ড ভঙ্গ। এতো উত্থান-পতন আর আবর্তনের ভেতরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কীভাবে সুস্থ মস্তিষ্কে বসবাস করেন তা ভেবে আমরা প্রবাসীরা অনেক সময়ই যথেষ্ট আশ্চর্য হই।

পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসবাস করেও টরন্টোবাসী যে কতখানি বাংলাদেশভিত্তিক জীবনযাপন করেন সেটাও আমাকে প্রায়শই বিস্মিত করে। শুধু যে দেশের খাবারদাবার, মানুষজন, সংস্কৃতি নিয়েই তারা সীমাবদ্ধ তা নয়, স্বদেশের কিংবা ফেলে আসা দেশের বিপদে-আপদে যে মহাবিক্রমে তারা যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেটা যে খুব কাছ থেকে দেখেনি সে বিশ্বাস করতেও পারবে না।

সাভারের রানা প্লাজার ধসকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা অসম্ভব। কোনো রাজনৈতিক দলকে টেনে না এনেই বলা যায়, আমাদের দেশের সত্তায়, স্তরে স্তরে যে সামগ্রিক অবজ্ঞা এবং দুর্নীতির প্রসার হয়েছে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অন্যের জমি দখল থেকে শুরু করে অনুমতির চেয়ে উঁচু দালান তৈরি করা, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে গরিব কর্মীদের ভয় কিংবা লোভ দেখিয়ে কাজে যোগদান করতে বাধ্য করা– এসবের কোনোটাই একজন বা দুজন ব্যক্তির সমন্বয়ে সম্ভব নয়। কত সহস্র মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্যায়ের শেষ অবস্থা এই মৃতের স্লোগান সেটা হিসাব করা দুষ্কর হবে।
যাইহোক, আমি যখন অসম্ভব ক্রোধে ফুঁসছি তখন এখানকার এক্স ক্যাডেটরা দলবেঁধে নেমে গেছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। সাভারের সেই ইট, লোহা আর সিমেন্টের জঙ্গলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসহায় হতভাগা নরনারীদের জীবন রক্ষা করার উপায় তাদের নেই কিন্তু তারা যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য, মৃতদের পরিবার-পরিজনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে লেগে যায়। এখানে এতো সীমিত সামথ্যের মধ্যেও এতো দ্রুত এতো অর্থের সমাগম হবে ভাবতেও পারিনি। তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে এগিয়ে এসেছে এখানকার বাংলাদেশী মানুষরা, সব বিভেদ ভুলে। মাত্র দুই দিনে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্রী রুদাবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে উঠে এলো প্রায় ১০ হাজার ডলার। ১৭ হাজার টাকায় প্রতিটি কৃত্রিম হাত-পায়ের দাম হিসাব করলে তাতে অনেক পঙ্গুর উপকার করা সম্ভব। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই যাত্রায় নেমেছেন রুদাবা। তাকে যেসব উদার প্রাণ, কর্তব্যপরায়ণ এক্স ক্যাডেটরা এবং অন্য বাংলাদেশীরা সাহায্য করেছেন তাদের সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের বর্ষীয়াণ বেলাল ভাইয়ের কথা উল্লেখ করতেই হয়। তিনি ডলারে ডলার মেলানোর ৪৮ ঘণ্টার ঘোষণা দিয়ে রুদাবার এই উদ্যোগকে দিয়েছিলেন এক নতুন প্রাণ।

হেফাজতের ঢাকা অবরোধের পর গণজাগরণের তরুণরা নাকি আবার তাদের মঞ্চে ফিরে এসেছেন। শাহবাগের মোড়ে প্রথম যখন এই আন্দোলনের শুরু হয় তখন হৃদয় উদ্বেলিত হয়েছিল। তার কারণ অবশ্য খুব যে এই আন্দোলনের সমর্থনের কারণে ছিল তা বলবো না। এই মোড়টির সঙ্গে হৃদ্যতা আমার দীর্ঘদিনের। জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি সেখান থেকে অনতি দূরেই। শাহবাগ মানেই আমার কাছে নিজ গৃহ, নিজ এলাকা। গণজাগরণের শুরু হওয়ার পর আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতার জীবন বেশ জটিল হয়ে পড়ে। যাতায়াতে খুবই সমস্যা। বাবা এখনো ফার্মেসিতে গিয়ে ডাক্তারি করেন। পুত্নীদের স্কুলে দেয়া-নেয়া করতে হয়। সবমিলিয়ে অনেক সমস্যা। অনেক ঘুরে যেতে হয়, সময় বেশি লাগে। মায়ের সঙ্গে কথা হলেই তার বিরক্ত অভিযোগ শুনতে হয়। আমার শুধু ভাবনা হয় যে, তরুণরা বা প্রাক তরুণরা স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিকা সঠিকভাবে জানে কি না সন্দেহ, কিংবা জানলেও আদতেই কতখানি অনুধাবন করতে পারে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তারা যখন বিচার বিভাগীয় রায়ের বিরোধিতা করে তুমুল হই হট্টগোল শুরু করে তখন যে হিতে বিপরীত হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সম্ভবত এই হেফাজতে ইসলামের আচমকা উত্থান।

যাইহোক, ভালো হোক আর মন্দ হোক ঘটনা আর ঝুটঝামেলা নিয়েই বাংলাদেশ। হেফাজতের তিন হাজার মানুষ হত্যা করে গুম করা হয়েছে এক রাতের মধ্যে, সেই গুজবও বেশ রসালো আলাপের সরঞ্জাম জুগিয়েছে। এই না হলে রাজনীতি!

পরিশেষে খানিকটা ব্যঙ্গের মতো শোনালেও না বললেই নয়। যারা ধৃষ্ঠতা ভাববেন তারা নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। ১৭ দিন পরে সাভারের ধ্বংসাবশেষ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরে এসেছেন ১৮ বছরের গার্মেন্টকর্মী রেশমা। বাংলাদেশের তাবৎ দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, শোষণ কোনো কিছুই এই তরুণীর বেঁচে থাকার তাগিদকে কেড়ে নিতে পারেনি। গ্রহে-নক্ষত্রে কীভাবে সবমিলে গেলে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে সেটা কল্পনা করার ভার পাঠকদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।

হলিটাইম্‌স/সাদি