হলি টাইমস রিপোর্ট :
আজ থেকে ১০ বছর আগে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর।সেই ঝড়ে বিশেষ করে বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি জেলার সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়, হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারান।ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় বনভূমি আর গবাদিপশুর। অসংখ্য মানুষ পরিবার পরিজন ঘর হারিয়ে দিনের পর দিন ঝুপড়িতে কাটাতে বাধ্য হন।
তবে গত দশ বছরে ঝড়ের সেই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
সিডর যে কত বড় ঝড় হতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারেননি শরণখোলার আঞ্জুমান আরা বেগম। তারা আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঝড়ে তাদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যও মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসে গবাদি পশু ভেসে যায়, ঘর ভেঙ্গে পড়ে, ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
আঞ্জুমান আরা বলছেন, ''সিডরের পর আমাদের ঘরবাড়ি, গাছপালার পর কিছুই ছিল না। দেশেও কোন কাজ ছিল না। এরপর বিভিন্ন এনজিও আসে। তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আমরা আবার চাষাবাদ শুরু করি। গরু মুরগি পালতে শুরু করি। কিছু সাহায্য পাইছিলাম। নিজেরাও চেষ্টা করছি। মুরগি বিক্রি করছি, হাসের ডিম বিক্রি করছি। এভাবে ধাপে ধাপে আবার সংসার ঠিক করেছি।''
এখন তিনি জমি কিনেছেন। স্বামী ছোটখাটো একটি ব্যবসা শুরু করেছে। তার এক ছেলে স্কুলে পড়ছে, আরেক ছেলে এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে।
আশ্রয় কেন্দ্র থেকে এসে বরগুনার পাথরঘাটার বাসিন্দা সোনা বেগম দেখতে পান, তার বাড়িতে ঘরের কোন চিহ্ন নেই। গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে আছে।
পরে ছেলে মেয়েদের নিয়ে ত্রাণের টিন দিয়ে তিনি দীর্ঘদিন চাপড়া ঘরে বাস করেন। বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হলে সেখানে কাজ করে বেশ কিছু টাকা জমান। পরে সেই টাকায় গরু ছাগল কিনে লালনপালন করে বড় করে বিক্রি করতে শুরু করে।
এখন আবার বাড়ি করেছেন। সেখান পুকুর আছে, গরু আছে।
খানিকটা ভিন্নতা থাকলেও সিডর আক্রান্ত এলাকাগুলোর সবার গল্পই অনেকটা একই রকম।
সিডরে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি আর প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। গবাদি পশু মারা যায় প্রায় আড়াই লাখ।
ঝড়ের পরপরই আক্রান্ত এলাকা গুলোয় সহায়তা কার্যক্রম শুরু করে সরকারি- বেসরকারি, দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
বাগেরহাটের সাংবাদিক ইসমাইল হোসেন বলছিলেন, ভয়াবহ সেই দুর্যোগ থেকে কাটিয়ে উঠতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
তিনি বলছেন, ''আর্থিক সাহায্য, বীজ, দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন গ্রামের মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কিভাবে ভালোভাবে ধান চাষ করতে হবে, কিভাবে গরু-ছাগল পালতে হবে। আগে এখানে গ্রামে মহিলাদের খুব একটা বাইরে দেখা যেতো না। কিন্তু সিডরের পর মহিলারাও নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে শুরু করেছেন। অনেকে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নিজেরাও ব্যবসা শুরু করেছেন।''
ক্ষতি কাটাতে এসব এলাকায় রাস্তাঘাট ও বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণের মতো উন্নয়নমুলক প্রকল্প যেমন নেয়া হয়েছে, তেমনি কৃষি, পশু পালনে অনেক প্রশিক্ষণমুলক প্রকল্পও নেয়া হয়।
বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল বসানোসহ গ্রামের বাসিন্দাদের বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে শেখানো হয়।
দুর্গম এলাকাগুলোতেও এসব এলাকায় অনেক সাইক্লোন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো সারা বছর স্কুল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি, বাগেরহাটের সাউথখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলছিলেন গত দশ বছরে নানা উদ্যোগ তাদের এলাকা অনেকটা পাল্টে দিয়েছে।
চেয়ারম্যান হক বলছেন, ''যারা মারা গেছে, সেই ক্ষতি তো আর কখনো পোষানো যাবে না। তবে সিডরের পর অনেক সাহায্য এসেছে। এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি অনেক সংস্থা আমাদের এলাকায় এখনো কাজ করছে। মানুষজন নিজেরাও নানাভাবে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। এখন বলা যেতে পারে, আমার এলাকায় অতি দরিদ্র বলতে আর কেউ নেই।''
যদিও অনেকের অভিযোগ, এত বছরেও বাধগুলোর কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি। ফলে আবার এরকম বড় ঘূর্ণিঝড় হলে জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থেকেই যাবে।খবর বিবিসির