ওই ক্ষুদ্রতম মহাকাশযানের নাম- স্প্রাইট। যা অনেকটা আমাদের মোবাইল ফোনের চিপ-এর মতো দেখতে। মেরেকেটে দেড় ইঞ্চি (সাড়ে ৩ সেন্টিমিটার) করে লম্বা আর চওড়া। মাত্র ০.৪৭২ ইঞ্চি (১২ মিলিমিটার) পুরু। আর ওজনে আমাদের নতুন ৫০ পয়সার কয়েনের (৩.৭৯ গ্রাম) চেয়ে সামান্য একটু বেশি। মাত্র ৪ গ্রাম। চলে শুধুই সৌরশক্তিতে। নিখরচায়!

আর ৪৫-৫০ বছর পর মানুষের তৈরি এমন মহাকাশযানই দাপিয়ে বেড়াবে ব্রহ্মাণ্ডে। আমাদের ছায়াপথ মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি তো বটেই, সেগুলি ঢুঁড়ে বেড়াবে অন্য গ্যালাক্সিগুলিতেও। ঢুঁড়ে বেড়াবে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমেও (ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম বা দু’টি নক্ষত্রের মাঝের এলাকাগুলি)। ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণের সন্ধানে তো বটেই, এই মহাকাশযানগুলিই আগামী দিনে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি রহস্যের জট খোলার জন্য হয়ে উঠতে চলেছে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।

ভিনগ্রহে বা ভিন মুলুকে প্রাণ বা প্রাণ সৃষ্টির উপাদান আছে কি না, জল তরল অবস্থায় সেখানে আছে কি না, সেখানকার বায়ুমণ্ডল মহাজাগতিক বিকিরণের লাগাতার হামলা এড়িয়ে টিকে রয়েছে কি না, থাকলে তা প্রাণের উপযোগী কি না, খুব তাড়াতাড়ি সেগুলি জানার জন্য এই ধরনের ছোট্ট মহাকাশযানই হয়ে উঠবে আমাদের আদর্শ হাতিয়ার।

কারণ, ভীষণ হালকা হওয়ায় এই ক্ষুদ্রতম মহাকাশযানগুলিকে ব্রহ্মাণ্ডে ছোটানো যাবে আলোর গতিবেগের অনেকটা কাছাকাছি বেগে। ফলে, এখনকার সর্বাধুনিক মহাকাশযানগুলিরও ব্রহ্মাণ্ডে যে দূরত্ব পেরতে হাজার হাজার বা কয়েক লক্ষ বছর লেগে যেত, এই স্প্রাইট মহাকাশযানগুলি সেই দূরত্ব পেরিয়ে যেতে পারবে অত্যন্ত অল্প সময়ে। যে দূরত্বে পৌঁছনো একটা মানবজীবনের মধ্যে অসম্ভব, এই স্প্রাইট মহাকাশযানগুলি সেখানে অবলীলায় পৌঁছে যেতে পারবে আমাদের জীবদ্দশাতেই।

‘ব্রেকথ্রু স্টারশট’ প্রকল্পের প্রথম টার্গেট, আমাদের এই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতেই আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রমণ্ডল আলফা সেনটাওরি। যে নক্ষত্রমণ্ডলটি রয়েছে আমাদের থেকে মাত্র ৪.৭ আলোকবর্ষ দূরে। মানে, আলোর গতিতে ছুটলে যেখানে আমরা পৌঁছব ঠিক ৪ বছর ৭ মাস পরে। ওই নক্ষত্রমণ্ডলে রয়েছে একটি গ্রহ। যার নাম- প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ভিনগ্রহে প্রাণ সৃষ্টির পরিবেশ বা উপাদান রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। তাই আলফা সেনটাওরি নক্ষত্রমণ্ডলের প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি গ্রহটিতে তড়িঘড়ি পৌঁছতে চাইছে মানবসভ্যতা। আর সেটা সম্ভব একমাত্র স্প্রাইটের মতো ক্ষুদ্রতম মহাকাশযানগুলির মাধ্যমেই।

ক্ষুদ্রতম মহাকাশযান কী? কেন প্রয়োজন? বোঝাচ্ছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যাক ম্যাঞ্চেস্টার। সৌজন্যে: কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়

আগামী দিনের সেই অভিযানের কথা মাথায় রেখেই এ বার পাঠানো হয়েছে ওই ৬টা ক্ষুদ্রতম স্প্রাইট মহাকাশযান। পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। দেখা হচ্ছে তাদের পারফরম্যান্স। যেন ‘ট্রায়াল রান’! রুশ কোটিপতি ইউরি মিলনারের ‘ব্রেকথ্রু স্টারশট’ প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবেই ইসরোর ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (পিএসএলভি)-সি৩৮’ রকেটের পিঠে চাপিয়ে মোট ৬টি স্প্রাইটকে পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। পৃথিবীর খুব কাছের কক্ষপথ বা লোয়ার আর্থ অরবিটে (এলইও)। তাদের মধ্যে দু’টি স্প্রাইট রয়েছে ইতালির মহাকাশযান ‘ম্যাক্স ভ্যালিয়ার’ আর লাটভিয়ার ‘ভেন্টা’ মহাকাশযানের গায়ে লাগানো। বাকি ৪টি স্প্রাইট রাখা আছে ইতালীয় মহাকাশযান ম্যাক্স ভ্যালিয়ারের মধ্যে। সেগুলিকে পরে ‘একা একা’ ছেড়ে দেওয়া হবে মহাকাশে। পরীক্ষা করে দেখা হবে সৌরশক্তির ওপর ভর করে তারা কতটা জোরে ছুটতে পারছে মহাকাশে। ঠিক মতো সিগন্যাল পাঠাতে পারছে কি না গ্রাউন্ড স্টেশনে।

কেন বানানো হল এই ক্ষুদ্রতম মহাকাশযান?

‘ব্রেকথ্রু স্টারশট’ প্রকল্পের উপদেষ্টা কমিটির প্রধান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্রাহাম লোয়েবের (অভি লোয়েব নামেও যিনি পরিচিত) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল আনন্দবাজারের তরফে। প্রথমে ই-মেলে, পরে টেলিফোনে।

প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে লোয়েব বলেছেন, ‘‘এখনকার সর্বাধুনিক মহাকাশযানগুলি নিয়ে যদি আমরা আজ রওনা হই সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রমণ্ডল আলফা সেনটাওরির দিকে, তা হলে সেখানে গিয়ে পৌঁছতে আমাদের কম করে ৩০ হাজার বছর সময় লেগে যাবে। যা সম্ভব হতে পারে আমাদের ৫০০ প্রজন্ম পর। কিন্তু আমাদের হাতে তো আর খুব বেশি সময় নেই। আমাদের জীবদ্দশাতেই সব কিছু করতে হবে। আমাদের সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে কাছের মুলুকে যদি তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হয়, তা হলে মহাকাশযানকে আরও অনেক অনেক বেশি গতিতে ছোটাতে হবে।  আলোর গতির পাঁচ ভাগের এক ভাগ গতিবেগে যদি ছোটাতে হয়,  তবে সেই মহাকাশযানগুলির চেহারাটা অতটাই ছোট আর ওজনে অতটাই সামান্য হতে হবে।’’


স্প্রাইট মহাকাশযান থেকে যে ভাবে পৃথিবীতে পৌঁছবে সিগন্যাল

এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চিন্তাটা যাঁর মাথায় প্রথম এসেছিল, আনন্দবাজারের তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল সেই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো জ্যাক ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গেও। ম্যাঞ্চেস্টার তাঁর ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘এই স্প্রাইট মহাকাশযানগুলি ৪.৭ আলোকবর্ষ দূরে থাকা (আলোর গতিতে ছুটলে যেখানে পৌঁছতে সময় লাগবে ৪ বছর ৭ মাস) আলফা সেনটাওরি নক্ষত্রমণ্ডলে পৌঁছতে সময় নেবে মাত্র ২০ বছর। পুরোপুরি সৌরশক্তিতে চলা স্প্রাইটগুলিকে পাঠানো সম্ভব হবে মহাকাশের সুদূরতম প্রান্তেও। অনেক অনেক অল্প সময়ে।’’

স্প্রাইট ঠিক কত দিনে পৌঁছতে পারবে পড়শি নক্ষত্রমণ্ডল আলফা সেনটাওরিতে?

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লোয়েব বলছেন, ‘‘এই স্প্রাইট মহাকাশযানগুলিকে পৃথিবীর খুব কাছের কক্ষপথে (লোয়ার আর্থ অরবিট) পাঠানো হয়েছে এদের পারফরম্যান্স বোঝার জন্য। এদের যথেষ্ট উপযুক্ত করে তুলতে সময় লাগবে আরও ২০ বছর। তার পর সেই স্প্রাইটগুলির আরও ২০ বছর সময় লাগবে পৃথিবী থেকে রওনা হয়ে আলফা সেনটাওরি নক্ষত্রমণ্ডলে পৌঁছতে। আর সেখান থেকে আমাদের কাছে সিগন্যাল এসে পৌঁছতে সময় লাগবে আরও প্রায় বছর পাঁচেক। যেহেতু সেই নক্ষত্রমণ্ডল রয়েছে ৪.৭ আলোকবর্ষ দূরে। মানে, আগামী ৪৫ বছরের মধ্যেই এই স্প্রাইটগুলির মাধ্যমে আলফা সেনটাওরি থেকে আমরা সিগন্যাল পেয়ে যাব বলে আশা করছি।’’

কী নেই আমাদের ৫০ পয়সার কয়েনের ওজনের সেই মহাকাশযানে! রয়েছে রেডিও (যা রেডিও সিগন্যাল পাঠাবে আর তা গ্রহণ করবে), গাইরোস্কোপ ( যা দিয়ে অটোপাইলট বা স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন করা যায়), মাইক্রোকন্ট্রোলার (যা মাইক্রোপ্রসেসর চালায়), সেন্সর, ম্যাগনেটোমিটার (চৌম্বকত্ব মাপার যন্ত্র), সৌরকোষ, কম্পিউটার। কোনও কিছুরই অভাব নেই সেই ‘দেশলাই বাক্স’ মানে, স্প্রাইটে!

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্রাহাম লোয়েব (বাঁ দিকে) ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো জ্যাক ম্যাঞ্চেস্টার

এমন ছোট মহাকাশযান বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। প্রথম যে ছোট মহাকাশযান বানানো হয়েছিল, যার নাম কিউবস্যাট। ২০১৪ সালে সেই কিউবস্যাট পাঠানো হয় মহাকাশে। সেই কিউবস্যাট বানিয়েছিলেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো জ্যাক ম্যাঞ্চেস্টার। তবে সেই কিউবস্যাটের ওজন ছিল এখনকার স্প্রাইটের কয়েকশো গুণ। এক কিলোগ্রামের কিছু বেশি। এই ওজন নিয়ে অন্য নক্ষত্রমণ্ডলে পৌঁছতে অনেক অনেক বেশি সময় লাগতো।

তাই কিউবস্যাটের জায়গা নিল স্প্রাইট। বিজ্ঞানীদের দাবি, এটাই আর ৫০ বছর পর হয়ে উঠবে মহাকাশ গবেষণার জন্য আমাদের অন্যতম প্রধান যান। ব্রহ্মাণ্ড ঢুঁড়ে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে হালকা, সবচেয়ে ছোট ফুরফুরে মহাকাশযান।

ভিনগ্রহে বা ভিন মুলুকে পৌঁছনোর স্বপ্নটাকে সত্যি করে তুলবে এই ‘দেশলাই বাক্স’! স্প্রাইট।সূত্র:আনন্দবাজার পত্রিকা

ছবি সৌজন্যে: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা